অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ইমেরিটাস অধ্যাপক, লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক। সমাজ ও রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে বলছেন-লিখছেন দীর্ঘকাল ধরে।
‘সমাজ ব্যবস্থা এবং বুদ্ধিজীবিতা’ প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের। আলাপচারিতায় তিনি বলেন, পুঁজির সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে মানব সভ্যতা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ব্যক্তি মালিকানার পরিবর্তে সম্পদের ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি বলেও মত দেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
বিজ্ঞাপন
জাগো নিউজ: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এ বছরই। অগ্রযাত্রা-উন্নয়নের ধারায় নানা গল্প আছে। আবার পশ্চাৎপদতার কথাও আছে। যেমন রাষ্ট্র, সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী নির্লিপ্ত প্রায়। বুদ্ধিজীবীদের এমন নীরবতা নিয়ে হতাশ জনসাধারণ। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমি মনে করি, বুদ্ধিজীবীরা কখনো নির্লিপ্ত থাকতে পারেন না। যারা নির্লিপ্ত থাকেন তারা বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যে পড়েন না।
বিজ্ঞাপন
প্রথমত, বুদ্ধিজীবীদের কাজ কী, এটি আলাদা করে ফেলতে হবে। সমাজের আর দশজনের সঙ্গে তার ভাবনার মিল নাও থাকতে পারে। তিনি যা ভাবেন, তা সচেতন এবং সজ্ঞানে। এই ভাবনা মানুষের কল্যাণ আসে।
আর এর বিপরীতের আলোচনা হচ্ছে রাষ্ট্র-সমাজের কেন্দ্রে থেকে সুবিধা নিয়েও এক শ্রেণীর মানুষ নিজেকে বুদ্ধিজীবী দাবি করেন। এদের আসলে বুদ্ধিজীবী বলা যায় না। এরা সুবিধাবাদী। রাষ্ট্র, সরকার খুব সূক্ষ্মভাবে এই সুবিধাবাদীদের সংখ্যা বাড়িয়ে চলছে।
বিজ্ঞাপন
বুদ্ধিজীবীরা সচেতন থেকে সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে ব্যাখ্যা করবেন এবং তা গণমানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। যে কাঠামা বা ব্যবস্থা রয়েছে তা বদলানোর জন্য উপযুক্ত যুক্তি দেবেন।
জাগো নিউজ: এখন কী দেখছেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীই নির্লিপ্ত। বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই নীরব রয়েছেন। আবার কেউ রাষ্ট্র, সরকারের কাছে থাকার চেষ্টা করছেন এবং সরকার যদি জনবিরোধী অবস্থান নেয় সেখানেও এই শ্রেণীর মানুষ সমর্থন দিচ্ছেন। তবে সবাই নির্লিপ্ত তা বলা যাবে না। কেউ না কেউ কথা তো বলছেন।জাগো নিউজ: এই নির্লিপ্ততার কারণ কী? কেন সুবিধাবাদীদের সংখ্যা বাড়ছে? এই ধারা কি স্বাধীনতার আগে থেকেই?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সুবিধাবাদীদের সংখ্যা বাড়ছে এটি যেমন সত্য, তেমনি তরুণরা শেকল ভাঙছে এটিও সত্য।
স্বাধীনতার পর তরুণরাই সকল সৃষ্টির মূলে। রাষ্ট্রীয় সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে তরুণরাই সবার আগে এগিয়ে এসেছেন। স্বাধীনতার আগেও তরুণরাই মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন। সেটা আন্দোলন হোক আর বুদ্ধিজীবিতার মধ্য দিয়েই হোক। এখনো তাই দেখবেন।
স্বাধীনতার আগে বুদ্ধিজীবীরা ভূমিকা রেখেছেন সত্য, কিন্তু তরুণরাই সবার আগে মানুষকে জাগ্রত করতে পেরেছেন। পাকিস্তান আমলেও বুদ্ধিজীবীদের অনেকে সরকারের আনুকূল্য পেয়েছেন। সুবিধা নিয়ে চুপ থেকেছেন। কিন্তু সেই চিত্র এখন আরও ভয়াবহ। পাকিস্তান আমলে বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে কথা বলতে পেরেছেন, এখন তা পারেন না। গণমাধ্যমের পরিধি বেড়েছে। তাতে লাভ কী? বাকস্বাধীনতা তো দিনকে দিন সংকুচিত হচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমশই হরণ করা হচ্ছে।
জাগো নিউজ: আজকের এই পরিস্থিতির জন্য বিশেষত কোন বিষয়কে সামনে আনবেন? শুধুই কি রাজনীতি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমার কাছে বিষয়টি একবারেই পরিষ্কার। স্বাধীনতার আগে আমাদের যে সংগ্রাম ছিল, সেটা হচ্ছে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। পুঁজিবাদ নির্দয়ভাবে বিকশিত হচ্ছিল। পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখতেই পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশে গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি শাসক শ্রেণী মূলত পুঁজিবাদেরই প্রতিনিধিত্ব করছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলো পুঁজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। পাকিস্তান ভেঙে গেল, কিন্তু ব্যবস্থাটা রয়েই গেল। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান উন্নয়নের দশক ঘোষণা করেছিলেন। ওই উন্নয়নের আড়ালে শোষণ-বৈষম্য ছিল। এখনো এদেশের সরকারগুলো বিভিন্ন উন্নয়ন বার্ষিকী ঘোষণা করছে। বৈষম্য-শোষণও বাড়ছে ব্যাপকভাবে।

আগে আঞ্চলিক শোষণ হয়েছে। এখন ব্যক্তি শোষিত হচ্ছে। এই শোষিতদের কোনো দল নেই। বুর্জোয়ারা নিজেদের স্বার্থে যেসব দল তৈরি করে রেখেছে, শোষিতরাও সেখানকার অংশ হয়ে যাচ্ছেন। অথচ এই মানুষগুলো তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারেন না। অর্থাৎ পুঁজিবাদের যে নিকৃষ্ট যাঁতাকল, জনগণ তাতে নিয়মিত পিষ্ট হচ্ছে।জাগো নিউজ: আপনারা তো পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না কেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: গণতান্ত্রিক মোড়কে সভ্যতার সর্বনাশ করা হলো। এই সংকট গোটা বিশ্বেই। মানুষের সামনে কোনো রাজনৈতিক দল নেই, যার ওপর বিশ্বাস করে ঘুরে দাঁড়াবে। আমরা সমাজতন্ত্রের কথা বলি। সমাজতন্ত্র মার খাচ্ছে সর্বত্রই। মূলত পুঁজির কাছেই মার খাওয়া।
আন্দোলন করার পথ নেই। রাজনৈতিকভাবেই আন্দোলন করতে হবে তা নয়। সাংস্কৃতিক চেতনা থেকে আন্দোলন হতে হবে। কিন্তু আমরা তো সাংস্কৃতিক মানটাও উন্নত করতে পারলাম না। কোনটি ‘কার্য’ আর কোনটি ‘কারণ’ তা আজও নির্ধারণ করতে পারিনি। এই ব্যর্থতা আমাদেরও।
বলতে পারেন, নিম্নমানের সাংস্কৃতিক চর্চার কারণেই আমরা আর এগোতে পারলাম না। সংস্কৃতি ন্যায় এবং অন্যায়ের মধ্যকার তফাৎ নির্ধারণ করে। অথচ পুঁজিই এখন সাংস্কৃতিক মান নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এমন আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি এবং সমর্থন দরকার, সেটিও নেই আমাদের।
শুধু গান-বাজনা, নাটক-সিনেমা প্রদর্শন করার নামই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নয়। এটি একটি আদর্শিক প্রয়াস। সমাজরই প্রতিটি জায়গা আদর্শচ্যুত। মানুষের মধ্যকার মানবিকতা লোপ পাচ্ছে। মানব সভ্যতা প্রান্তিক পর্যায়ের সন্ধিক্ষণে। এমন সন্ধিক্ষণে মানুষ বুঝে উঠতে পারছে না, পুরাতনেই থাকবে নাকি নতুনে যাত্রা করবে।
জাগো নিউজ: নতুন ধারা…
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: পুঁজিবাদের ধারা হচ্ছে সম্পদের ওপর ব্যক্তির মালিকানা। এটি মানুষকে মুক্তি দিতে পারেনি। সভ্যতাকে গ্রাস করছে এই ধারা। এর বিপরীতের ধারা হচ্ছে সম্পদের ওপর সমাজ বা রাষ্ট্রের মালিকানা। সম্পদের ওপর সমাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠা পেলে সভ্যতা রক্ষা পাবে।
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারি আবারও প্রমাণ করল ব্যক্তি মালিকানা ব্যবস্থা মানুষকে মুক্তি দিতে পারে না।
জাগো নিউজ: গোটা বিশ্বই যখন পুঁজির ফাঁদে আটকা তখন নিজেদের নিয়ে আলাদা করে ভাবা যায়?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, গোটা বিশ্বই পুঁজির খপ্পরে। কিন্তু এই ব্যবস্থা তো ভাঙার সময় এসেছে। মানুষ মুক্তি চাইছে। বিশ্বজুড়ে পরিবর্তন করতে হবে। করোনা পরিস্থিতি কিন্তু এই উপলব্ধি বাড়িয়ে দিয়েছে।
জাগো নিউজ: আশার কথা কী বলবেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আশার কথা হচ্ছে, মানুষ বুঝতে পারছে যে, এই ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মানুষের এই বুঝটা আরও উচ্চতর জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। কারণ প্রতিবেশি ভালো না থাকলে আমিও ভালো থাকব না, তার প্রমাণ হচ্ছে করোনা সংকট। পালিয়ে থেকেও মানুষ রক্ষা পাচ্ছে না।
সময়ের ব্যবধানে হয়ত করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসবে, কিন্তু আগামীকাল কোন মহামারি আসবে তা কেউ জানি না। আর সব সংকট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে সাংস্কৃতিক মুক্তির মধ্য দিয়ে।